গত সপ্তাহে একটি সেশনে মডারেটর হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, যেখানে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে একত্রিত হয়েছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে—কীভাবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদগুলো সত্যিকারের পরিবর্তনের দূত হয়ে জলবায়ু সহনশীল উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
আইপিসিসি-এর মতে, বাংলাদেশ পৃথিবীর সপ্তম সর্বাধিক জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশটির প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, যা সরাসরি প্রভাব ফেলে প্রায় ৬৩ লাখ মানুষের জীবনে।
রয়টার্স জানায়, শুধুমাত্র ২০২৪ সালেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৭৮ কোটি মার্কিন ডলার—যা দেশের মোট জিডিপির ০.৪ শতাংশের সমান।
এই সংখ্যাগুলো হয়তো অনেকের কাছে ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষ প্রতিদিন টের পায় জীবিকার শতবর্ষব্যাপী সংগ্রাম। প্রতিদিন হাজারো মানুষ ঢাকায় আসে—ইচ্ছায় নয়, প্রয়োজনে; কখনও উন্নত জীবনের আশায়, আবার অনেক সময় বাঁচার তাগিদে।
তেমনই একজন জেরিনা খাতুন। বর্তমানে তিনি ঢাকার এক বস্তিতে বাস করেন এবং গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। তার স্বামী ঢাকায় রিকশা চালান। দক্ষিণ উপকূলীয় জেলা ভোলার বাসিন্দা জেরিনা নদীভাঙনে ঘর হারিয়েছেন।
চোখে জল নিয়ে তিনি বলছিলেন, তার দুই বোন ও তিন ভাই এখন দেশের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে আছেন। বছরের পর বছর দেখা হয় না সবার। গ্রামে ফেরার স্বপ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, মনের গভীরে এখনো টান আছে শৈশবের স্মৃতি আর জন্মভূমির প্রতি, কিন্তু বাস্তবে ফেরার কোনো সুযোগ নেই।
আরেকটি গল্প নজরুল ইসলামের। পাঁচ সন্তানের জনক নজরুল এখন ঢাকার এক বস্তিতে থাকেন। একসময় গাইবান্ধার এক গ্রামের তিনি ছিলেন ছোট কৃষক। কিন্তু যে নদী একসময় তাদের জীবনের উৎস ছিল, সেটিই একদিন রূপ নেয় বিভীষিকায়—বাড়িঘর, ফসল আর উর্বর জমি সবকিছু গ্রাস করে। দুই ভাই একসময় অবিচ্ছেদ্য ছিলেন, এখন দূর জেলার বাসিন্দা। ফোনে যোগাযোগ থাকলেও, পাঁচ বছর ধরে তাদের দেখা হয়নি।
এই মানুষগুলো যুদ্ধের কারণে নয়, জলবায়ু দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত। তারা শুধু ঘরবাড়ি হারায়নি, হারিয়েছে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জীবনযাত্রার মূলভিত্তি। জলবায়ু পরিবর্তন নীরবে মানুষকে তাদের শিকড় থেকে ছিন্ন করছে—দুর্বলদের আরও দুর্বল করে তুলছে।
নজরুলের জীবনের গল্পটি দেখায়, কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মানুষকে অনিশ্চিত জীবিকার দিকে ঠেলে দেয়। একসময় গর্বিত কৃষক ছিলেন তিনি, এখন রোদে পুড়ে ক্লান্ত রিকশাচালক। দিন শেষে বাড়ি ফিরে পান সামান্য বিশ্রামের সুযোগ—স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সংকীর্ণ ঘরে।
এই প্রেক্ষাপটে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভূমিকা হয়ে ওঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সবচেয়ে নিম্নস্তর হিসেবে ইউপি গ্রামীণ শাসন ও উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি।
একাধিক গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিটি ইউনিয়ন সরকারি সম্পদ ও নীতিকে সরাসরি মানুষের বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করে। তাই জলবায়ু সহনশীল উন্নয়ন ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হলে ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী করতেই হবে, যাতে মানুষ শহরমুখী না হয়ে গ্রামে থেকেই টেকসই জীবিকা গড়তে পারে।
খুলনার দাকোপ উপজেলার এক কমিউনিটি নেত্রী বলেন, কীভাবে নিরাপদ পানির সংকট দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে তাদের এলাকায়। মানুষ এখন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। চাষাবাদ কমে যাওয়ায় আয় কমেছে, আর্থিক অনিশ্চয়তা বেড়েছে। অনেক পরিবার বাধ্য হচ্ছে লবণাক্ত বা দূষিত পানি পান করতে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ও কিশোরীরা পানি সংগ্রহের ভার বহন করে। দূর-দূরান্তে পানি আনতে গিয়ে তারা শারীরিক কষ্ট, মানসিক চাপ ও যৌন হয়রানির ঝুঁকির মুখে পড়ে। অনেকে স্বেচ্ছায় নিজের পানি পান কমিয়ে দেন, কারণ পরিবারে পুরুষদের চাহিদা আগে মেটানো হয়।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইউনিয়ন পরিষদগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাজেট প্রণয়নে জনগণের অগ্রাধিকারকে প্রতিফলিত করতে হবে, পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে ইউপি স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধান দিতে পারবে। একইসঙ্গে, জাতীয় পর্যায়ে নীতি প্রণয়নে ইউপি প্রতিনিধিত্বকে গুরুত্ব দিতে হবে—কারণ তারাই মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমের প্রথম নেতৃত্বদানকারী।
জেলে সম্প্রদায়ের উদাহরণটিও প্রাসঙ্গিক। ইলিশ মাছ ধরার মৌসুমি নিষেধাজ্ঞার সময় তারা আয়হীন হয়ে পড়ে। বিকল্প সহায়তা না থাকায় অনেকেই অবৈধভাবে মাছ ধরতে বাধ্য হয়। ইউপি সেই সময় জীবিকা সহায়তার পরিকল্পনা নিতে পারে—যা একদিকে দারিদ্র্য কমাবে, অন্যদিকে টেকসই মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণে সাহায্য করবে।
তবুও কাঠামোগত দুর্বলতা রয়ে গেছে। অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তারা ইউপি অফিসে না থেকে উপজেলা শহরে বা জেলায় থাকেন, পরিবারের সুবিধা বা সন্তানদের পড়াশোনার কারণে। এতে সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।
এই ব্যবধান কমাতে ইউপিগুলোকে আর্থিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও মানবসম্পদ দিক থেকে শক্তিশালী করতে হবে। স্থানীয় জ্ঞান ও সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তারা যেন পরিকল্পনা করতে পারে এবং কমিউনিটির অংশগ্রহণে জলবায়ু ঝুঁকি কমাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে।
যদি ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে এভাবে ক্ষমতায়িত করা যায়, তাহলে নজরুল ইসলাম ও জেরিনা খাতুনের মতো মানুষ তাদের নিজ গ্রামে থেকেই জীবিকা পুনর্গঠন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতে পারে। এতে শহরমুখী অভিবাসন চাপ কমবে, আর বাংলাদেশ আরও পরিকল্পিত ও টেকসই নগরায়নের পথে এগোবে।
এখনই সময় উদ্যোগ নেওয়ার। ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী করা শুধুই শাসন সংস্কার নয়—এটি জলবায়ু সহনশীল বাংলাদেশ গঠনের এক জরুরি অগ্রাধিকার, যেখানে মানুষ তাদের শিকড়, জীবিকা ও মর্যাদা অটুট রেখে এগিয়ে যেতে পারবে।
মাহিউল কাদির, পরিবেশ বিষয়ক কলাম লেখক

