ঢাকার ব্যবসায়ী আবীর আবদুল্লাহ সময় পেলেই দেশে-বিদেশে ঘোরেন। কিন্তু যাতায়াতের ঝক্কি-ঝামেলার কারণে সুন্দরবনে যাওয়ার সুযোগ হয়নি কখনো। পদ্মা সেতু সেই বাধা দূর করে দিয়েছে। আগামী সপ্তাহেই সপরিবার সুন্দরবন যাচ্ছেন তিনি। লক্ষ্য, রাস পূর্ণিমার মেলা দেখা।
আবীর আবদুল্লাহ বলেন, ‘আগে সড়কপথে খুলনা যেতে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা লাগত। এত সময় নষ্ট হবে ভেবে সুন্দরবন যাওয়া হয়নি। এখন রাতে বাসে উঠব, সকালে খুলনা নেমে সরাসরি জাহাজে গিয়ে উঠব। এরপর তিন দিন সুন্দরবন ঘুরব।’
শুধু আবীর আবদুল্লাহ নন, তার মতো হাজারো পর্যটকের কাছে সুন্দরবন এখন অন্যতম আকর্ষণীয় ভ্রমণ গন্তব্য। পদ্মা সেতুর কল্যাণে ঢাকা থেকে খুলনা, বাগেরহাট বা সাতক্ষীরার দূরত্ব কমেছে। অনেকে আবার সরাসরি জাহাজে করে বুড়িগঙ্গা থেকে সুন্দরবনে ভ্রমণে আসেন প্যাকেজের মাধ্যমে। উন্নত জলযান, নিরাপত্তা ও নতুন পর্যটন স্পট—সব মিলিয়ে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বাড়ছে পর্যটক, বাড়ছে রাজস্ব আয়। বনের পাশে গড়ে উঠছে পরিবেশবান্ধব ইকো কটেজ, যা বদলে দিচ্ছে স্থানীয় অর্থনীতি।
একসময় সুন্দরবন ভ্রমণ ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আর আধুনিক জাহাজের অভাবে অনেকেই সাগর বা পাহাড়কে বিকল্প হিসেবে বেছে নিতেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই চিত্র বদলেছে। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টোয়াস) তথ্যমতে, বর্তমানে তাদের ৬৫টির বেশি নিবন্ধিত জাহাজ পর্যটকদের নিয়ে সুন্দরবনে যায়। গত দুই বছরেই এ খাতে যুক্ত হয়েছে ১০-১৫টি বিলাসবহুল নৌযান।
তিন রাত দুই দিন অথবা দুই রাত তিন দিনের প্যাকেজে সাধারণ মানের জাহাজে পর্যটকদের জনপ্রতি খরচ হয় ৭-৮ হাজার টাকা। বিলাসবহুল জাহাজে খরচ হয় ২২-২৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। প্যাকেজের আওতায় থাকার কেবিন, খাওয়া, বনে ভ্রমণ—সবই অন্তর্ভুক্ত।
প্রতিজন দেশি পর্যটকের জন্য বন বিভাগকে রাজস্ব দিতে হয় ১ হাজার ৫০ টাকা এবং বিদেশি হলে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। সুন্দরবনের ভ্রমণের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ দিনের অনুমতি পাওয়া যায় বন বিভাগ থেকে। তবে একদিনের জন্য অনেকেই অর্থাৎ সকাল সন্ধ্যা এই প্যাকেজে বাগেরহাটের মোংলা থেকে ট্রলার ও ছোট জালিবোটে করে সুন্দরবনের করমজল ও হাড়বাড়িয়া এলাকায় ঘুরতে যান পর্যটকরা। সেখানে এই কাজে নিযুক্ত আছে অর্ধশতাধিক নৌযান। এ ছাড়া সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ এলাকা থেকেও একইভাবে পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণে যান।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে পর্যটক ও রাজস্ব আয় দুটোই সমানভাবে বাড়ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যেখানে রাজস্ব আয় ছিল ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকায়। ওই অর্থবছরে সুন্দরবনে পর্যটক এসেছেন ২ লাখ ১৬ হাজার জনের বেশি।
২০২০-২১ অর্থ বছরে সুন্দরবনে এসেছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ২১১ জন পর্যটক। যারমধ্যে দেশি পর্যটক ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮৯১ জন এবং বিদেশি পর্যটক ৩২০ জন। এর পর প্রায় ধারাবাহিকভাবে সুন্দরবনে পর্যটক সংখ্যা বেড়েছে। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভ্রমণ করেন ৩ লাখ ২৮ হাজার জন পর্যটক। এরমধ্যে বিদেশি পর্যটক ছিলেন ১ হাজার ৭৩৪ জন।
তবে ট্যুর অপারেটররা বলছেন, দেশি পর্যটকদের সংখ্যা বাড়লেও বিভিন্ন কারণে বিদেশি পর্যটকদের আসা কমে গেছে। এর জন্য তারা প্রধানত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে দায়ী করেছেন।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জেড এম হাসানুর রহমান জানান, আগে বনের কটকা, কচিখালি, দুবলারচর, হিরণ পয়েন্ট, হাড়বাড়িয়া, কলাগাছিয়া ও করমজল এই সাতটি পর্যটন স্পট ছিল। নতুন করে শরণখোলার আলীবান্ধা, চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক, খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক ও কৈলাশগঞ্জে আরও চারটি পর্যটন স্পট হয়েছে।
সুন্দরবন ভ্রমণের প্রচলিত ধারণার বাইরে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ইকো কটেজ ও রিসোর্ট। বনের পাশেই খুলনা ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে ২০টির বেশি ইকো কটেজ। জঙ্গলবাড়ি, ইরাবতী, গোলকানন, বনবাসের মতো এসব কটেজে পর্যটকেরা বনের নিবিড় সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন।
তরুণ উদ্যোক্তারা পদ্মা সেতুকে ঘিরে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন। এসব কটেজকে কেন্দ্র করে স্থানীয় কয়েকশ পরিবারের কর্মসংস্থান হয়েছে। যারা একসময় ঝুঁকি নিয়ে বনে সম্পদ আহরণ করতেন, তারা এখন পর্যটন গাইড, নৌকার মাঝি বা অন্যান্য সেবা দিয়ে আয় করছেন।
রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া হোসাইন শাওন বলেন, ‘বনকে ভালো রাখাটাই আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পরিবেশবান্ধব পর্যটন আরও এগিয়ে যাবে।’
ট্রলারে করে করমজল, কালাবগী বা কলাগাছিয়া যেতে খরচ হবে ট্রলারপ্রতি ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকা। সেখানে ২০ থেকে ৩০ জন একসঙ্গে ভ্রমণ করতে পারেন। হাড়বাড়িয়া, শেখেরটেক ও দোবেকীর মতো কিছু জায়গায় যেতে খরচ পড়ে ৬ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা।
তবে যারা গভীরভাবে সুন্দরবন উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য রয়েছে ট্যুর অপারেটরদের বিভিন্ন প্যাকেজ। তবে সবথেকে পছন্দনীয় প্যাকেজ নেন পর্যটকরা তিন দিন–দুই রাতের প্যাকেজ। এতে ভ্রমণের অনুমতি থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া, থাকা, নিরাপত্তা—সবকিছুর ব্যবস্থা থাকে। সাধারণত জনপ্রতি খরচ পড়ে ৭ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লঞ্চে বা ক্রুজ শিপে গেলে খরচ ১৪ হাজার ৫০০ থেকে ২২ হাজার টাকার মধ্যে।
খুলনা বা সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ থেকে শুরু হওয়া এই ভ্রমণ আরও রোমাঞ্চকর। ১০–১৫ জনকে নিয়ে ছোট্ট ট্রলার যায় বনের গভীরে। নিরাপত্তার জন্য থাকে বনরক্ষী ও গাইড। দুই রাত তিন দিনের এই ভ্রমণে ভ্রমণকারীরা নিজের ইচ্ছামতো বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে পারেন। জনপ্রতি খরচ প্রায় ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকা।