নারীর পোশাকে আটকে থাকা ‘বৈষম্যহীন’ বাংলাদেশ

Date:

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনা আমাদের অনেকেরই নজরে এসেছে। প্রথমটা অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের। ‘ওড়না কোথায়’ প্রশ্ন তুলে এক নারীকে হেনস্তা করতে নামে কয়েকজন তরুণ। সামাজিক মাধ্যমে সেই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ হেনস্তাকারীকে গ্রেপ্তার করে।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘটনাটা ঘটে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে। গত ২৯ অক্টোবর এক নারীকে পোশাকের কারণে হেনস্তা করে বাসের হেলপার। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ওই হেনস্তাকারীকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

সর্বশেষ ঘটনাটি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। সহপাঠীর খুনের বিচার চেয়ে আন্দোলন করা এক ছাত্রীর পোশাক নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। সেই মন্তব্যের অডিও ক্লিপ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সমালোচনার মুখে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েই পার পেয়ে যান ওই শিক্ষক।

তিনটি ঘটনাই সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমের কল্যাণে আমাদের চোখে পড়েছে। সারাদেশে নারীদের পোশাকের কারণে হেনস্তা হওয়ার ঘটনা আরও বেশি বৈ কম হওয়ার কথা নয়। এ ধরনের কোনো ঘটনার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে অনেক মানুষ এই হেনস্তার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে— এমন প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। ভাবখানা এমন—নারীর পোশাক বা কাজ পুরুষের মনমতো না হলে নারীকে লজ্জা পেতে হবে। নারী যেহেতু লজ্জা পাচ্ছে না, সুতরাং লজ্জা দেওয়ার দায়িত্বটা তারাই নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিচ্ছেন। নারী বা পুরুষ যে কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রেই যে অন্য কারও হস্তক্ষেপ শিষ্টাচার, শালীনতা বিরোধী—এ সাধারণ সভ্যতা বোধটুকু তারা মানেন না বা জানেন না।

বাংলাদেশে নারীরা গত কয়েক দশকে শিক্ষা থেকে শিল্প খাত, রাজনীতি থেকে অর্থনীতি— সবখানেই সক্ষমতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ নারী দেশের অর্থনীতিতে কোনো অংশে পুরুষদের তুলনায় কম অবদান রাখছেন না। সেই নারীকে মাপার প্রধান মানদণ্ড হয়ে উঠেছে ‘পোশাক’। পোশাক নিয়ে নারীকে হেনস্তা করার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়, তবে সম্প্রতি এটা যেন আরও বেড়েছে।

কেন বাড়লো?

আপাতদৃষ্টিতে এ প্রশ্নের উত্তর সহজ মনে হলেও আসলে বিষয়টা অত সহজ নয়। বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং বহুযুগ ধরে ধর্ম, বর্ণ ও নৈতিকতার মোড়কে চর্চিত পিতৃতন্ত্র এই বাড়বাড়ন্ত অবস্থার নেপথ্যে বললে ভুল হবে না। নারীকে জনসমক্ষে নানাভাবে হেয় করে তার আত্মবিশ্বাস, তার সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করলে পুরুষশাসিত সমাজেরই লাভ।

বাংলাদেশে দীর্ঘসময় নারী প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় প্রধান থাকলেও নারীর ক্ষমতায়ন উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। আবার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ইত্যাদি নানা খাতে নারীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও নারীকে নিয়ে সামাজিক মনস্তত্ত্বের মধ্যে পরিবর্তনের হাওয়া ততটা অনুকূল নয়। এর কারণ প্রধানত সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও পরিবেশের বিকাশ না ঘটা। যেমন, দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতা নারী। কিন্তু এ দলগুলোতেও কি নারীর অবস্থান সম্মান ও মর্যাদার? প্রধান নেতাদের প্রভাবে কি দলগুলোতে নারী নেতৃত্বের বিকাশ হয়েছে?

বৈষম্যমুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ নির্মাণের যে স্বপ্ন মানুষ গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেখেছিল, বর্তমানে রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরে সেটাও কি ফিকে হয়ে আসছে না? সব ধরনের বৈষম্যের অবসান, লিঙ্গ-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষের অন্তর্ভুক্তিই কথাই তো আমরা শুনছিলাম। তেমনটা হচ্ছে কি?

কতটা সংস্কার হচ্ছে, কতটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণ হচ্ছে— সেটা বুঝতে এত খোঁজাখুঁজির দরকার নেই। জুলাই গণঅভ্যুথ্থানের পর দেশ সংস্কারের জন্য যে জুলাই সনদ হলো, সেখানে নারী উন্নয়নের কোনো সুপারিশই নেই।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। সেখানে নারী প্রতিনিধি একজনও না থাকাটা বোধ হয় আমাদের আর অবাক করে না। কখনো প্রবল সমালোচনার মুখে এক-দুজন নারী প্রতিনিধি স্থান পেলেও তারা যে আসলে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ ছিলেন, তা নিয়েও বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনও গঠন করেছিল। ওই কমিশনের প্রতিবেদনের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা হওয়ার আগেই অনেকে এর বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লাগলেন। কমিশনের সদস্যদের অত্যন্ত নোংরা ভাষায় আক্রমণ করা হলো। কিন্তু সরকার তা নিয়ে একটা টু শব্দও করল না।

রাজনৈতিক দলগুলো বলে যে তারা রাষ্ট্র এবং জনগণের সেবা করার জন্যেই রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চায়। রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে তাদের তৎপরতায় আমরা কখনো তটস্তও হয়ে উঠি। কিন্তু এ দলগুলো নারীর প্রশ্নে কতটুকু বৈষম্যহীন নীতি অনুসরণ করে? তারা নারীকে কতটা ধারণ করে? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর আমাদের কাছে নেই। আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকাঠামোর পক্ষে যুগ যুগ ধরে সাফাই গাইছে, সম্মতি উৎপাদন করে চলেছে।

ধর্ষণসহ নানারকম যৌন হয়রানি হলে ভুক্তভোগী নারীর চরিত্র-হননে নামার হিড়িক পড়ে, এমনকি রাষ্ট্রের অধীন সংস্থাগুলোও বাদ যায় না। ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা হয়, নারীর চরিত্র খারাপ, পোশাক খারাপ বলেই এমনটা হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের অনেকেই অভিযোগ জানান, পুলিশের কাছে গেলে বা আদালতে গেলে নারীর চরিত্র নিয়ে আপত্তিকর কথা বা ভাবভঙ্গি প্রদর্শন করা হয়। অপরাধী নয়, বরং ভুক্তভোগীই সমাজে একঘরে হয়ে পড়েন।

এ ধরনের মনন পরিবর্তনে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক উদ্যোগ থাকলে এতদিনে অবস্থার উন্নতি আমরা দেখতে পেতাম। যেহেতু তা নেই, তাই আমরা সমাজের সর্বস্তরে দেখি এক চরম অগণতান্ত্রিকতা, পিতৃতন্ত্রের জয়জয়কার। আমরা দেখি পোশাক নিয়ে কটূক্তিকারীকে জেল থেকে মব করে বের করে ফুলের মালা গলায় দেওয়া হয়, হেনস্তাকারীর কাজকে সঠিক বলে অনলাইনে-অফলাইনে প্রচারণা চালানো হয়, নারীর পোশাক ও শরীরকে জড়িয়ে রসিয়ে রসিয়ে বয়ান করা হয় হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতার সামনে।

আমরা দেখি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে কারো বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও প্রশাসন বিচারে গড়িমসি করে। বিচারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হয়। আমরা দেখি রাজনৈতিক দলগুলো নারী নিপীড়নের প্রশ্নে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করতে পারে না—নিজেদের মান-সম্মানসহ নানা বিবেচনায়। আর রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে ধর্ষক-নিপীড়করা ছাড়া পেয়ে যায় সব সরকারের আমলে, বিচার পরিণত হয় নিদারুণ প্রহসনে।

এত অপমান, নিপীড়নের পরেও থেমে নেই বাংলাদেশের নারীরা—এটাই আশা জাগানিয়া। উপরে বলা তিনটি ঘটনাতেই আমরা দেখতে পাই, ভুক্তভোগী নারীরা এসব হেনস্তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন যার যার সাধ্য আর শক্তি নিয়ে। আঘাতের জবাবে বাসে হেনস্তার শিকার নারী দমে না গিয়ে পাল্টা আঘাত করেছেন।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষার্থী কটূক্তিকারী ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘আমি আপনাকে প্রশ্ন করি, কাকে আপনি ন্যাংটা মেয়ে বলেন? আমার পোশাক আমার স্বাধীনতা না? আমার পোশাক আমি যেইভাবে ইচ্ছা, সেইভাবে পরতে পারি না? আপনার লজ্জা লাগলে আপনি চলে যান।’

কিন্তু ট্রাজেডি হলো, কখন কার লজ্জা পেতে হবে—এ সাধারণ বোধটুকুও আমাদের সবার সমান নয়।

spot_imgspot_img

Popular

More like this
Related

মানুষকে প্রতিস্থাপন নয়, ব্যবসায়ে যোগাযোগ বাড়াতে সহায়তা করবে এআই

একটা নীরব পরিবর্তন এখন ব্যবসার জগৎ পাল্টে দিচ্ছে। কেবল...

স্থানীয় নেতৃত্ব, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ: জলবায়ু সহনশীলতার অগ্রযাত্রায় ইউনিয়ন পরিষদ

গত সপ্তাহে একটি সেশনে মডারেটর হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগ...

প্রথম দেখায় প্রেম নাকি ঝগড়া হয়েছিল ইয়াশ–তটিনীর?

পরিচালক শিহাব শাহীন ড্রামা, থ্রিলার, রোমান্টিক গল্পে কনটেন্ট বানাচ্ছেন...

চিড়িয়াখানায় প্রাণীর প্রতি মানবিক আচরণ করা হয় না: ফরিদা আখতার

চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হয় না বলে...