বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের রাজধানী নয়াদিল্লিতে আবারো এসে গেছে দূষণের মৌসুম। এই সময়ে প্রায় চার কোটি মানুষ টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে বিষাক্ত দূষণের মধ্যে কাশি ও হাঁপানিতে ভোগে।
প্রতি বছরের শীতের শুরুতেই নয়াদিল্লি ও আশপাশের শহরগুলোর আকাশ ঢেকে যায় একধরনের ধূসর কুয়াশায়। গাড়ির ধোঁয়া, আগুনের ধোঁয়া ও ধুলোর মিশ্রণে এই ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। এতে আকাশ পুরো ঢেকে যায়।
মাত্র এক সপ্তাহ আগেই দীপাবলি উৎসবের আতশবাজিতে দিল্লির আকাশ আলোয় ভরে উঠেছিল। উৎসবের উচ্ছ্বাসে ঘন ধোঁয়ায় বাতাস আরও ভারী হয়ে ওঠে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দিল্লি সরকার এখন মনে করছে, সমস্যার প্রতিকার হয়তো ‘ক্লাউড সিডিং’ বা কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি ঘটানোর মধ্যেই নিহিত, যেন বৃষ্টিতে এই ধোঁয়া ও দূষণ কিছুটা কাটানো যায়।
দিল্লি সরকার কী করছে?
মঙ্গলবার বিকেলে একটি ছোট উড়োজাহাজ নয়াদিল্লির আকাশে মেঘের মধ্যে ছিটিয়ে দেয় অল্প পরিমাণে সিলভার আয়োডাইড ও সোডিয়াম ক্লোরাইড যৌগ। এর উদ্দেশ্য ছিল কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি নামানো।
এই ‘ক্লাউড সিডিং’ বা কৃত্রিম বৃষ্টির পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের লক্ষ্য শীতকালে দিল্লির ক্রমবর্ধমান দূষণ মোকাবিলা করা।
উড়োজাহাজটি উড়েছিল উত্তর প্রদেশের কানপুর শহর থেকে, যা দিল্লি থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে। কানপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (আইআইটি) বিজ্ঞানীদের পরামর্শে রাজধানীর নির্দিষ্ট অংশে এই পরীক্ষামূলক বৃষ্টি ঘটানো হয়।
এর আগে গত সপ্তাহে সরকার একটি পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন সম্পন্ন করে এবং সেটিকে সফল বলে ঘোষণা দেয়। মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্ত এই উদ্যোগকে দিল্লির জন্য ‘সময়ের দাবি’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এটি শহরের দীর্ঘদিনের পরিবেশগত সংকট মোকাবিলায় ‘একটি সাহসী পদক্ষেপ’।
কেন দিল্লির বায়ু এত দূষিত?
প্রতি শীতে দিল্লির বাতাস ধুলো, ধোঁয়া আর রাসায়নিকের ঘন ও বিষাক্ত মিশ্রণে পরিণত হয়। তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের গতি কমে যায়। আর টেম্পারেচার ইনভার্সন নামে এক ধরনের আবহাওয়াগত প্যাটার্ন দূষিত বায়ুকে উপরে উঠতে দেয় না।
সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি করে বাতাসের অতিক্ষুদ্র ধূলিকণা বা পিএম ২.৫ কণা। এরা এত ক্ষুদ্র যে রক্তপ্রবাহেও ঢুকতে পারে। গাড়ির ধোঁয়া, কারখানার নির্গমন, নির্মাণকাজ থেকে আসা ধুলোবালি বাতাসের ঘনত্ব আরও বাড়ায়। তার ওপর আশপাশের কৃষিনির্ভর রাজ্যগুলোতে খড় পোড়ানোর ধোঁয়া বাতাসে কালো কার্বন ও ধোঁয়ার অতিরিক্ত স্তর যোগ করে।
এই ধুলো ও ধোঁয়ার সঙ্গে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো গ্যাস মিশে আরও ক্ষতিকর নতুন কণা তৈরি করে। ফলস্বরূপ শহর ঢেকে যায় ঘন ও ধূসর কুয়াশায়—যা চোখে, ফুসফুসে এবং হৃৎপিণ্ডের ক্ষতি করে।
দীর্ঘ সময় ধরে এই দূষিত বাতাসের সংস্পর্শ ফুসফুসের রোগ, হৃদরোগ, শ্বাসনালীর সংক্রমণ এবং গর্ভকালীন জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। আর দীপাবলির আতশবাজি এই ঝুঁকিপূর্ণ বাতাসকে আরও ঘন করে।
ক্লাউড সিডিং কীভাবে কাজ করে
ক্লাউড সিডিংকে সহজভাবে বলা যায়—আকাশে “হালকা ঝাঁকি” দিয়ে বৃষ্টি নামানোর চেষ্টা। বিজ্ঞানীরা মেঘের ধরন, উচ্চতা, বাতাসের অবস্থা এবং আর্দ্রতা বিবেচনায় প্রথমে নির্ধারণ করেন কোন মেঘে বৃষ্টি তৈরি করা সম্ভব।
এরপর উড়োজাহাজ বা ড্রোনের মাধ্যমে মেঘে ছিটিয়ে দেওয়া হয় সূক্ষ্ম লবণ কণা, সাধারণত সিলভার আয়োডাইড। এসব কণা মেঘের ভেতরে ‘বীজের মতো” কাজ করে। জলীয় বাষ্প এই কণার চারপাশে জমতে শুরু করে। যত বেশি বাষ্প জমে, তত ভারী হয়ে পড়ে। অবশেষে এই কণা বৃষ্টিতে পরিণত হয়।
মঙ্গলবার কানপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, কীভাবে উড়োজাহাজের সঙ্গে যুক্ত ফ্লেয়ার থেকে সূক্ষ্ম লবণ কণা মেঘের মধ্যে ছিটানো হচ্ছে।
এটি কি কার্যকর?
ক্লাউড সিডিং কার্যকর কি না, এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভিন্নমত রয়েছে। দিল্লির আইআইটির সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক সায়েন্সেসের অধ্যাপক শাহজাদ গণি ও কৃষ্ণ অচুতারাও দ্য হিন্দুতে লেখা এক কলামে উল্লেখ করেন, ক্লাউড সিডিং প্রাকৃতিক মেঘ তৈরি করতে পারে না এবং বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে এর নির্ভরযোগ্য প্রমাণ এখনও দুর্বল এবং বিতর্কিত।
বিশেষজ্ঞরা আরও সতর্ক করেছেন যে, বৃষ্টির পর মাটিতে জমে থাকা লবণ সময়ের সঙ্গে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
তাদের মতে, কৃত্রিম বৃষ্টি শুধুমাত্র সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু নয়াদিল্লির দীর্ঘমেয়াদি দূষণের সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়।
গণি ও অচুতারাও লেখেন, ক্লাউড সিডিং হলো এক ধরনের চটকদার কৌশল, যা শুধু চোখ ধাঁধানো মনে হয়। এটি বাস্তব সমস্যা সমাধানের বিকল্প নয়, ঠিক যেমন স্যাম টাওয়ার বা অন্যান্য অ-বৈজ্ঞানিক উদ্যোগ।

