আলুর দাম কম, ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক

Date:

গত বছরের বাজারে নভেম্বরে আলুর দাম ছিল চড়া। সেই আশায় রংপুরের নবদিগঞ্জের কৃষক খায়রুল ইসলাম এ বছর ১০ লাখ ৯২ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আলু চাষ করেন।

কেবল খায়রুল ইসলাম নয়, দেশের হাজারো কৃষক এ বছর আলু চাষে বেশি বিনিয়োগ করেছেন। ফলে আলুর রেকর্ড ফলন হয়েছে। কিন্তু বাজারে চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত সরবরাহ থাকায় প্রত্যাশিত দামের চেয়ে কমে আলু বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত মৌসুমে দেশে ১ কোটি ১৫ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে, যেখানে বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৯০ লাখ টন।

অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে খায়রুলের মতো কৃষকদের এখন ক্ষতির অঙ্ক কষতে হচ্ছে।

কারওয়ান বাজারের পাইকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বর্তমান আলুর দাম খুবই কম। এই দামে কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠবে না।’

গতকাল পাইকারি বাজারে আলু বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৯ থেকে ১২ টাকা দরে, যা গত দুই সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা কম।

তিনি বলেন, ‘বাজার দরের এই পরিস্থিতি কৃষকদের পরবর্তী মৌসুমে আলু চাষে নিরুৎসাহিত করবে।’

লালমনিরহাটের লোকমান হোসেন জানান, তিনি বৃহৎ পরিসরে আলু চাষ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

লোকমান হোসেন এ বছর তিন একর জমিতে আলু চাষ করেছেন। তার উৎপাদন খরচ ছিল প্রতি কেজিতে ১৮ টাকা এবং বিক্রির আশা করেছিলেন ২৫ টাকা দরে।

কিন্তু ফসল তোলার সময় তাকে অর্ধেক আলু ১৫ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। বাকি অর্ধেক কোল্ড স্টোরেজে রাখেন, সেগুলো ভালো দামে বিক্রির আশা করছিলেন।

‘কিন্তু এখন কোল্ড স্টোরেজের আলুও ১২ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তাই আমার উৎপাদন খরচই উঠছে না। আলু চাষ করে আমি এখন হতাশ,’ লোকমান বলেন।

বিশেষজ্ঞরা আলু চাষিদের বর্তমান সংকটের জন্য সরকারকেই দায়ী করছেন। তাদের মতে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) কৃষকদের অতিরিক্ত চাষের বিষয়ে আগেভাগে সতর্ক করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এছাড়া সরকারের ঘোষিত কোল্ড স্টোরেজের ন্যূনতম দর (প্রতি কেজি ২২ টাকা) এবং ৫০ হাজার টন আলু কেনার পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হয়নি।

প্রসঙ্গত, কৃষকের ক্ষতি কমাতে ৫০ হাজার টন আলু কেনার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। পাশাপাশি বলা হয়েছিল, কোল্ড স্টোরে রাখা প্রতি কেজি আলুর সর্বনিম্ন দর হবে ২২ টাকা। গত ২৭ আগস্ট এই ঘোষণা দিয়েছিল কৃষি মন্ত্রণালয়। কিন্তু সেই ঘোষণার দুই মাস পার হলেও আলু কেনা হয়নি। আর কৃষক পাননি ২২ টাকা দর। এতে আলুর দাম আরও কমেছে, আর বেড়েছে কৃষকের হাহাকার।

মুন্সিগঞ্জের কদম রাসুল কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক প্রশান্ত কুমার মণ্ডল বলেন, ‘এখন বাজারে দামে ধস নেমেছে। এতে কৃষক ও ব্যবসায়ী উভয়েই বিপদে পড়েছে।’

তার কোল্ড স্টোরেজে বর্তমানে ১০০ জনের বেশি কৃষক ও ব্যবসায়ীর ২০ হাজার বস্তা আলু মজুত আছে।

তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন মাত্র ২০০ বস্তা আলু বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বস্তায় ২৮০ টাকা ভাড়া দেওয়ার পর কৃষকদের লাভ হচ্ছে মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টাকা। এভাবে ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা অসম্ভব।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাবিবুর রহমান স্বীকার করেন, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতি কেজি আলু ২২ টাকায় বিক্রি নিশ্চিত করার উদ্যোগটি বিভিন্ন কারণে বাস্তবায়িত হয়নি।

কৃষি বিপণন কর্মকর্তা এ বি এম মিজানুল হক বলেন, ‘আলুর দাম প্রতিদিন আরও কমছে। নভেম্বরেই নতুন আলু বাজারে আসবে, তখন পুরনো আলুর চাহিদা আরও কমে যাবে।’

অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, পুরো বিষয়টি সরকারের দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং কৃষকদের প্রতি অগ্রাধিকারের অভাবের প্রতিফলন।

তিনি বলেন, বারবার সতর্কবার্তা দেওয়া সত্ত্বেও সরকার কৃষকদের সংকটকে গুরুত্ব দেয়নি। এর ফলে বহু কৃষক ক্ষতির মুখে পড়েছেন, ঋণের জালে জড়িয়েছেন এবং এখন মারাত্মক আর্থিক সংকটে ভুগছেন।

তার ভাষ্য, ‘এটা পুরোপুরি ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতা। দাম পড়ে গেলে সরকার ফ্লোর প্রাইস (ন্যূনতম দর) নির্ধারণ করতে পারত, কিন্তু তারা দেরি করে ফেলেছে।’

তার মতে, ‘চার-পাঁচ মাস পর জনমনে ক্ষোভ দেখা দিলে সরকার প্রতি কেজি আলুর দাম ২২ টাকা নির্ধারণ করে। এতে কেবল উৎপাদন খরচ উঠতে পারে। তবে ন্যূনতম লাভের কোনো নিশ্চয়তা নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। সরকারের উচিত ছিল কৃষকদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে আলু কেনা।’

তার ভাষ্য, ‘মোট উৎপাদন ১ কোটি টনের বেশি হওয়ায়, সরকারের উচিত ছিল ১২ থেকে ১৩ লাখ টন আলু কেনা। কিন্তু তারা মাত্র ৫০ হাজার টন কিনেছে।’

‘এ বছর ক্ষতির কারণে কৃষকরা আগামী মৌসুমে আলু চাষ কমিয়ে দেবেন। ফলে উৎপাদন কমবে, দাম বাড়বে এবং ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন,’ যোগ করেন তিনি।

এ পরিস্থিতি দেশের সুষম কৃষি নীতির অভাবকে সামনে এনেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন ১৩ অক্টোবর কৃষি মন্ত্রণালয়কে এক চিঠিতে সতর্ক করেছে, সরাসরি পদক্ষেপ না নেওয়া হলে অনেক কৃষক কোল্ড স্টোরেজে থাকা বীজ আলু বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। এতে আগামী বছরের উৎপাদন ঝুঁকিতে পড়বে।

spot_imgspot_img

Popular

More like this
Related

মানুষকে প্রতিস্থাপন নয়, ব্যবসায়ে যোগাযোগ বাড়াতে সহায়তা করবে এআই

একটা নীরব পরিবর্তন এখন ব্যবসার জগৎ পাল্টে দিচ্ছে। কেবল...

স্থানীয় নেতৃত্ব, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ: জলবায়ু সহনশীলতার অগ্রযাত্রায় ইউনিয়ন পরিষদ

গত সপ্তাহে একটি সেশনে মডারেটর হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগ...

প্রথম দেখায় প্রেম নাকি ঝগড়া হয়েছিল ইয়াশ–তটিনীর?

পরিচালক শিহাব শাহীন ড্রামা, থ্রিলার, রোমান্টিক গল্পে কনটেন্ট বানাচ্ছেন...

চিড়িয়াখানায় প্রাণীর প্রতি মানবিক আচরণ করা হয় না: ফরিদা আখতার

চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হয় না বলে...